আমার দেশের সংবাদ ডেস্ক : ‘‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়িতো নয় পাখির বাসা ভেন্না পাতার ছানি, একটুখানি বৃষ্টি হলেই গড়িয়ে পড়ে পানি। একটুখানি হাওয়া দিলেই ঘর নড়বড় করে, তারি তলে আসমানীরা থাকে বছর ভরে। পেটটি ভরে পায় না খেতে, বুকের ক-খান হাড়, সাক্ষী দিছে অনাহারে কদিন গেছে তার’’------পল্লী কবি জসীমউদ্দিনের আসমানী কবিতার কথা আমাদের হয়তো মনে আছে। ১৯৪৬ সালে পল্লী কবি জসীমউদ্দিন ফরিদপুর সদর উপজেলার ঈশান গোপালপুর ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের আসমানীর দুরাবস্থা নিয়ে এ কবিতাটি রচনা করেন। কিন্তু এ যুগের আসমানীরুপী জোলেখা আক্তার ঝুমুরদের দেখতে হলে কুমিল্লার নাঙ্গলকোট পৌরসদরের কেন্দ্রা গ্রামের খোরশেদের বাড়ি যেতে হবে। যেখানে ঝমুরদের ঝুপড়ি ঘরে অমানবিক জীবন-যাপনের চিত্র দেখে অনেকের পল্লী কবির আসমানীর কথা মনে পড়ছে। তাদেরকে বৃষ্টি, ঝড়ো হাওয়া এবং নিত্যদিন খাবারের জন্য যুদ্ধ করে জীবন কাটাতে হয়।
গত ২রা মে জোলেখা আক্তার ঝুমুরের চাচাতো ভাই কলেজ শিক্ষার্থী জাফরুল হায়দার হৃদয় নাঙ্গলকোট বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের করোনা বিষয়ে সচেতনতা ও অসহায়দের খাদ্য সহায়তায় জন্য গঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হ্যালো ‘সংশপ্তকের’ সমন্বয়ক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী জহিরুল ইসলামকে ফোন দিয়ে ঝুমুরদের দু’দিন ধরে না খেয়ে থাকার বিষয়টি জানায়। বাংলাদেশ প্রতিদিন সম্পাদক নঈম নিজামের আর্থিক সহায়তায় করোনা ভাইরাসে অসহায়দের খাদ্য সহায়তার অংশ হিসেবে ‘সংশপ্তক’ টিমের সমন্বয়ক জহিরুল ইসলাম চাল, মুরগী, ডাল, সবজিসহ বিভিন্ন খাদ্য সহায়তা নিয়ে তাদের বাড়িতে হাজির হন। বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হওয়ার পর ঝুমুরদের অমানবিক জীবনযাপনের করুণ চিত্র পাদ প্রদীপের নিচে আলো হয়ে দেখা দেয়।
গত ৩ রা মে শনিবার দুপুরে সরেজমিনে তাদের বাড়িতে গিয়ে তাদের জীবনযাপনের করুণ চিত্র দেখার সুযোগ হয়। ঝুমুরের মা মনোয়ারা বেগম একটু আগে হওয়া বৃষ্টির পানিতে ঘরের মেঝে ভিজে যাওয়ায় পানি মুছে শুকিয়ে নিচ্ছেন। এসময় ঝুমুর ও ঝুমুরের মা তাদের জীবনের করুণ দুর্দশার বাস্তব চিত্র তুলে ধরেন।
জোলেখা আক্তার ঝুমুরদের ভাঙ্গা একচালা দু‘রুমের ঝুপড়ি টিনের ঘর। টিনের ফুটো দিয়ে ঘরময় পানি পড়ে। বৃষ্টির হাত থেকে ঘর রক্ষায় ঘরের চালায় গাছের ডালপালা, পাতা এবং পলিথিন দেয়া হয়েছে। এছাড়া বৃষ্টির পানি আটকাতে ঘরের ভিতরে বিভিন্নস্থানে বল, বাটি, পাতিল বসানো হয়েছে। যাতে করে ঘরে পানি না পড়ে। কিন্তু তারপরও ঘরে পানি পড়ে। ঝড় আসলে চরম আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়। বৃষ্টিতে তাদের অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হয়। ঘরের চতুর্দিকে সিমেন্টের খালি ব্যাগ দিয়ে বেড়া দেয়া হয়েছে। ঘরের দরজা কোনভাবে আটকে রাখা হয়। নিরাপত্তাহীনতায় ঝুমররা বিবাহযোগ্য চার বোনসহ অসুস্থ মাকে নিয়ে থাকেন। টয়লেটের চতুর্দিকেও সিমেন্টের ব্যাগ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়। রান্না ঘর নেই। আয়-রোজগারের কোন ব্যবস্থা না থাকায় এলাকার বিত্তবান মানুষদের নিকট থেকে সাহায্য-সহযোগিতা নিয়ে খেয়ে না খেয়ে কোনভাবে বেঁচে আছেন।
জোলেখা আক্তার ঝুমুর (১৬) এই ভাঙ্গা ঘরেই গত ১০বছর থেকে অসুস্থ বিধবা মা মনোয়ারা বেগম (৫০), স্বামী পরিত্যক্তা বোন কুলসুম আক্তার (২২), অপর বোন তাছলিমা আক্তার কোহিনুর (২০), সাথী আক্তার নুপুর (১৮) ও বোন কুলসুম আক্তারের ছেলে প্রতিবন্ধী আরাফাত হোসেন শুভকে (১২) নিয়ে খেয়ে না খেয়ে অমানবিক জীবনযাপন করছেন। এক বোন ফাতেমা আক্তার রুপালীর বিয়ে হয়েছে। বাড়ির ২শতক সম্পত্তি ছাড়া আর কোন সম্পত্তি নেই। একটি ভালো ঘর এবং আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় জোলেখা আক্তার ঝুমুরসহ অপর তিন বোনের বিবাহও হচ্ছে না। ঝুমুর চলতি বছর নাঙ্গলকোট বেগম জামিলা মেমোরিয়াল বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষার দেওয়ার কথা থাকলেও পরীক্ষার ফরম পুরণের টাকা সংগ্রহ করতে না পারায় পরীক্ষা দিতে পারেননি।
ঝুমুরের পিতা আবু তালেব ওরপে কালা মিয়া কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। একদিন ধান মাড়াতে গিয়ে তার চোখে ধান পড়ে একটি চোখ অন্ধ হয়ে যায়। পরে আরো একটি চোখ অন্ধ হয়ে দীর্ঘ রোগ ভোগের পর গত ১৬বছর পূর্বে মারা যান। তার মা মনোয়ারা বেগম ফেনীতে বাসাবাড়িতে ঝি এর কাজ করে মেয়েদেরকে বড় করেন। ফেনীতে একবার তার বাবার চিকিৎসা করতে গিয়ে তার মা ট্রাকের ধাক্কায় মাথায় প্রচন্ড আঘাত পান। সেই থেকে মায়ের মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। মায়ের চিকিৎসায় বোনের স্বর্ণালংকার বিক্রিসহ ঋণ করে অনেক টাকা খরচও করেন। এখনো সবসময় তাকে মাথা এবং কোমরের ব্যাথায় ভুগতে হচ্ছে। টাকা না থাকায় চিকিৎসাও করতে পারছেন না। তার মায়ের শরীর অসুস্থ থাকায় গত চার বছর ধরে কোন কাজকর্ম করতে পারে না। সেই থেকে তাদের দুর্ভোগ শুরু হয়। বোনরা পড়ালেখা না করায় কোন চাকুরি পান না।
পাশ্ববর্তী শ্রীকামতা গ্রামের খায়ের মিয়া মজুমদার প্রবাসী ছেলে-মেয়েদের থেকে টাকা এনে প্রায়ই তাদের সহযোগিতা করেন। পৌর কাউন্সিলর আলাউদ্দিনও বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করেন। ঝুমুরের মা সরকারিভাবে বিধবা ভাতা এবং সরকারের ১০টাকা মূল্যের চাল দুই ঈদে পেয়ে থাকেন বলেন জানান। আয় বলতে তাদের একমাত্র বিধবা ভাতা। এছাড়া প্রতিবেশীদের সাহায্য সহযোগিতা নিয়ে কোনভাবে বেঁচে আছেন। ঝুমুর জানান, তাদের একটি ঘর, টয়লেট এবং রান্নাঘর প্রয়োজন। সে এজন্য বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহবান জানান। এছাড়া তাদের বোনদের একটি চাকুরির ব্যবস্থা হলেও তাদের জীবনটা একটু স্বচ্ছলভাবে চলতো বলে সে জানায়।
নাঙ্গলকোট পৌরসভার মেয়র আবদুল মালেক বলেন, বিধবা মনোয়ারা বেগমের পরিবারকে পৌরসভা থেকে সব ধরণের সহযোগিতা করে আসছি। তাদেরকে ঘর করার জন্য অনেকবার টিন দেয়া হয়েছে। এছাড়া অনেক প্রবাসী ঘর করার জন্য টাকা দিলেও তারা ঘর করে নাই। তারা অর্ধাহারে-অনাহারে আছে এটা ঠিক নয়। এ অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি এরমধ্যে তাদের বাড়িতে খাবার পাঠিয়েছি। আমার সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে তাদেরকে ঘর করে দেব।
উপজেলা নির্বাহী অফিসার লামইয়া সাইফুল বলেন, তাদের বাড়ির সম্পত্তির কাগজপত্র নিয়ে আমার নিকট আবেদন করলে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে অবশ্যই তাদেরকে ঘর করে দেয়ার ব্যবস্থা করবো।
(সাইফুল ইসলাম শাহিনের এফবি থেকে সংগ্রহিত)