নিজস্ব প্রতিনিধি : মৎস্য অধিদপ্তরের অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতির বরপুত্র হিসেবে খ্যাত মৎস্য অধিদপ্তরের প্রকল্প পরিচালক আলিমুজ্জামান। একাধিকবার বরখাস্ত হয়েও রয়েছেন বহাল তবিয়তে। সেই সঙ্গে বগুড়াসহ প্রকল্পের আওতাভূক্ত জেলাসমূহে তার মনোনিত সিন্ডিকেট দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে মৎস্য দপ্তরের সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের সার্বিক কর্মকান্ড। চিহ্নিত এই সিন্ডিকেট দ্বারা প্রকল্পের টাকা আত্মসাৎ, ভূয়া পদোন্নতি, বিধি লঙ্ঘন ও প্রভাব বিস্তাত করে প্রকল্প পরিচালকের পদ হাতিয়ে নেয়াসহ হেন কাজ নেই যা তিনি করছেন না। ফলে প্রকল্পের আওতাভুক্ত মৎস্য অফিস সমূহে দেখা দিয়েছে বিশৃঙ্খলা। এতে করে মৎস্য অফিসের সার্বিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে, এমনটাই জানিয়েছেন অফিসের একাধিক কর্মকর্তা কর্মচারী।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক পদটি ৪র্থ গ্রেডের। সে মোতাবেক প্রকল্পের ডিপিপিতে ৪র্থ গ্রেড উল্লেখ রয়েছে। জানা গেছে প্রাক্তন সচিব রইসুল আলম মন্ডল সকল বিধিবিধান লঙ্ঘন করে ৬ষ্ঠ গ্রেডের নন ক্যাডার ও দুর্নীতিবাজ ইঞ্জিনিয়ার আলিমুজ্জামানকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেন। আলিমুজ্জামান চৌধুরীর বিরুদ্ধে বিগত ২০১১ সালের ১৩ ফেব্রæয়ারী অদক্ষতা, অসদাচরণ ও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হলে, ২০১১ সালের ২৮ ফেব্রæয়ারী তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর আগেও তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির দায়ে সিলেট জেলার জৈস্তাপুর থানায় ৩১ আগস্ট ১৯৯৪ সালে মামলা হয়, মামলা নং ৬। এ ক্ষেত্রেও ঐ সময় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
সরেজমিনে বগুড়া জেলা মৎস্য অফিসে গিয়ে একাধিক কর্মকর্তার সাথে কথা বলে জানা যায়, বগুড়া জেলার বিভিন্ন পুকুর পুন:খনন কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে প্রকল্প পরিচালক ও জেলা প্রকৌশলী আব্দুর রউফ এর বিরুদ্ধে। ঘুঘার পুকুর পুনঃখনন প্রকল্পের সভাপতি ওহিদুল দুদক বরাবর অভিযোগ করে জানান ১০% হারে কমিশনের টাকা প্রকল্প পরিচালককে না দিলে কাজ পাওয়া যায় না। বাধ্য হয়ে শর্ত মেনে নিয়ে ৫ লাখ টাকা আলিমুজ্জামানের আত্মীয়র একাউন্টে ২০১৮ সালে ৪ঠা নভেম্বর ফরিদপুর শাখা এক্সিম ব্যাংকে চৌধুরী এন্টারপ্রাইজ হিসাব নং-০৪৯১১১০০১৬৮০৭৩ জমা দিতে হয়। একইভাবে ২০১৯ সালের ৩১ মার্চ ইবিএল ব্যাংক মতিঝিল শাখার হিসাব নং-১০১২০২০০০৩৪৯৭-এ ১ লাখ টাকা জমা দেন। পরবর্তীতে চতুর্থ কিস্তির টাকা হাতে হাতে জমা দেন। এ বিষয়ে ওহিদুলের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, পিডি ও বগুড়া জেলা মৎস্য অফিসের উপ-প্রকৌশলী আব্দুর রউফ স্যারকে ১০% হারে টাকা না দিলে কাজ পাওয়া যায় না। এমন কি বিল পাস করাতেও টাকা দিতে হয়। এসব টাকা জেলা মৎস্য অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আঃ রউফের মাধ্যমে পিডি স্যার নেন বলে জানান ওহিদুল। এদিকে ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আরডি প্রকল্পের আওতায় বগুড়া জেলার উপ-সহকারী প্রকৌশলী আঃ রউফ প্রকল্পের দল নেতাদের নিকট থেকে নির্দিষ্ট অংকের ঘুষের টাকা আদায় করেন বলে জানা গেছে। এসব এলাকায় বিল কাতলাহার প্রকল্পে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা, উন চুরকি ২০ হাজার, জয়ভোগা ১ লাখ ৩০ হাজার, পার লহ্মীপুর ১০ হাজার, মোলাম গাড়ী ১৩ হাজার ৭শত, কলস দহ ২ লাখ, বটর গারী ৩৪ হাজার, চৌধুরী কোলা ২০ হাজার, ঘুঘার পুকুর ৪ লাখ, নাকাটি ৩০ হাজার, খলসাগাড়ী পান্ডা ৭০ হাজার, কড়াদাম ২ লাখ ও লেতনা পুকুর পুনঃখনন প্রকল্পে ২ লাখ টাকা ঘুষ নেয় পিডি আলিমুজ্জামানের পক্ষে বগুড়া মৎস্য অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আঃ রউফ।
জলাশয় সংস্কার মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রকল্পের কাজ সমাপ্তির পর জেলা উপ-সহকারী প্রকৌশলী আঃ রউফ এই অডিট বাবদ ১.৫%, সাংবাদিক বাবদ ০.৫% এবং দুদক বাবদ ০.৫%, তার নিজস্ব খরচ বাবদ ০.২৫% টাকা আদায় করেন। আদায়কৃত ৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা ২০১৯ সালের ২৯ জুলাই প্রকৌশলী আঃ রউফ জেলা মৎস্য দপ্তরের প্রধান সহকারী শহিদুল ইসলামের নিকট জমা রাখেন। এ সংক্রান্ত এক পত্রে বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ ইমরান হোসেন চৌধুরী, বগুড়া সদর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শারমিন আক্তার, সোনাতলা উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ এমদাদুল হক ও আরিফ আহম্মেদ (শাজাহানপুর) স্বাক্ষর করেণ। প্রকল্প পরিচালকের অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়ে মৎস্য অধিদপ্তর কর্তৃক একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক (অর্থ ও পরিকল্পনা) মোঃ মাহবুবুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি বগুড়ায় তদন্তকালে সমস্ত তথ্য ও প্রমাণের আলোকে পিডির বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বলে উপস্থাপন করেছেন, তাতে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রওশন আরার কোনো বক্তব্য উপস্থাপন করা হয়নি। এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রওশন আরার সাথে কথা বললে তিনি জানান, তদন্ত কমিটি দুর্নীতির সাথে জড়িতদের বিষয়ে আমার কোন মতামত নেন নি।
অপরদিকে বগুড়া জেলা মৎস্য অফিসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী আঃ রউফের সাথে কথা বললে তিনি জানান, তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সবই মিথ্যা। একইভাবে বগুড়া মৎস্য অফিসের প্রধান সহকারী শহিদুল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি ৫ লাখ ৩৪ হাজার টাকা তার কাছে গচ্ছিত রাখার বিষয়টি এরিয়ে যান।
বগুড়া জেলা মৎস্য অফিসের অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতায় ইতিমধ্যেই ভেঙ্গে পড়ছে অফিসের সার্বিক শৃঙ্খলা। ফলে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে মৎস্যচাষী ও উপকারভোগী জনগোষ্ঠী। তাই জনস্বার্থে অবিলম্বে অনিয়ম, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার সাথে জড়িত কর্মকর্তা কর্মচারীদের অন্যত্র বদলির মাধ্যমে অফিসের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার দাবী জানিয়েছেন বগুড়ার সচেতন মহল। দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক আলিমুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে, তিনি সব মিথ্যা, ভিত্তিহীন বলে এ প্রতিবেদককে জানান।