সাইদুর রহমান রিমন: আমার ব্যাপারে অন্ধ পক্ষপাতিত্ব করা, পেশাগত কাজে তৎপর হতে তাগিদ দেয়া, শান্তনার সুর তুলে পারিবারিক শান্তি নিশ্চিত রাখার নিয়ামক-আমার একমাত্র সন্তান উর্মিকে বিদায় দিচ্ছি আজ। সে একাকী চলে যাচ্ছে জার্মানির বার্লিনে, উচ্চ শিক্ষার ব্রত নিয়ে। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে কম্পিউটার সাইন্সে অনার্স শেষ করে এবার জার্মানির বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপ নিয়েই তার মাস্টার্সসহ বিশেষায়িত ডিগ্রি অর্জনই তার লক্ষ্য। শিক্ষার শুরু থেকেই ডবল জাম্পিং করে করে যে তর তর করে ক্লাশগুলো ডিঙ্গিয়েছে; ফলে বয়সের সঙ্গে খাপ খায়নি মোটেও। এ কারণেই অনার্স ডিগ্রিধারী মেয়েটি আমার আজও ভাতের ডিসের কাছে প্লেট এগিয়ে ধরে বলে উঠে; আম্মু কতটুকু ভাত নেবো? সেই মেয়েকেই একাকী করে পাঠিয়ে দিচ্ছি হাজার হাজার মাইল দূরের শহরে? যেখানে নিজের সবকিছু নিজেকেই গুছিয়ে চলতে হবে। রান্নাবান্না থেকে পরিচ্ছন্নতা, সাজগোজ, চলাফেরা, সিদ্ধান্ত নেয়া পর্যন্ত সবকিছুই নিজেকে ম্যানেজ করতে হবে। সামান্য জ্বর হলে যে নেতিয়ে পড়ে, বন্ধ করে দেয় খাওয়া দাওয়া। বার কয়েক বকা না খেলে ওষুধপথ্যের কাছেও যায় না...তার দিনাতিপাত কিভাবে চলবে তা আন্দাজ করতেও কষ্ট হচ্ছে।
গত কয়েকদিন এসব ভেবেই মনটা খারাপ ছিল, বারবার শুধু ভেবেছি এতটুকু মেয়েকে আমি একাকী করে দূর নির্বাসনে পাঠাচ্ছি। কিন্তু আজ বিষয়টা উল্টো মনে হচ্ছে। আসলে মেয়েটাকে পাঠিয়ে আমি নিজেই বড্ড বেশি একাকী হতে চলেছি। দিনমান হাজারো ঝক্কি, কত শত অনিশ্চয়তা, ব্যর্থতার গ্লানি বয়ে রাতে যখন বাসায় ফিরতাম একটা নিশ্চিত আশ্রয় ছিল আমার। রাত ২টা, আড়াইটা, ৩টা কিংবা পৌণে ৪টা-যখনই বাসায় ফিরতাম; লিফটের মৃদু ঘর্ষণজনিত শব্দেই মেয়ে আমার গেট খুলে অকৃত্তিম হাসি নিয়ে অপেক্ষমাণ থাকতো। বাবা বলে চিৎকার জুড়ে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা ছিল তার নিত্য অভ্যাস। আর এটুকু জড়িয়ে ধরার বিনিময়েই আমার যেন সারাদিনের সব ক্লান্তি মুহূর্তেই উ’বে যেতো। এতেই আমি সৃষ্টিশীলতার নতুন শক্তিতে বলিয়ান হয়ে উঠতাম। শুধু সন্তান বলে কথা নয়, প্রিয়জনদের সান্নিধ্য হয়তো যে কাউকে নতুনভাবে উদ্দীপ্ত করার ক্ষমতা দিয়ে থাকে। টানা তিন-চার বছরের জন্য মেয়েকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়ে সেই উদ্দীপ্ততা, সেই নিশ্চিত আশ্রয়, সেই ক্লান্তি দূরের অব্যর্থ নিয়ামক হারাতে যাচ্ছি আমি? তবে তো আমি নিজেই বেশি একা হয়ে পড়ছি, আমার হারানোর পরিমাণটাই তো দেখছি সবচেয়ে বেশি।
আমার স্ত্রী চামেলী অবশ্য আরেকটু বেশি হারাবার পথে। সে একাধারে গল্পের মানুষ হারাচ্ছে, বান্ধবীত্ব হারাচ্ছে, হারাচ্ছে অভিভাবকত্বও। প্রতিমুহূর্তে কপোট রাগ দেখানো, মৃদু ধমকে শিক্ষাদান, নামাজের জন্য কঠোর শাসন, নিজের কষ্ট আনন্দ শেয়ার করার মতো সব ভাল লাগা থেকেই বঞ্চিত হতে যাচ্ছে সে। পক্ষান্তরে মেয়েকে একা পাঠিয়ে আমরা যখন তারই নিঃসঙ্গতার কথা ভাবছি তখন ফোন আর ম্যাসেঞ্জার অবিরাম ব্যস্ত থাকছে জার্মানি থেকে আগত ক্ষুদে ম্যাসেজ আর কথাবার্তায়। সেখানে পৌঁছাবার আগেই তার গড়ে তোলা ভার্চুয়াল স্বজন আর বান্ধবীদের উদ্দীপনা দেখেই বুঝে নিতে পারছি আমার মেয়েটির পরিচিতির নতুন গন্ডি প্রস্তুত হয়ে আছে। বরং আমরাই হারাচ্ছি পরিচিত গন্ডি। আর কিছু না হোক, মেয়েকে হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছি তো.....
আজ ঠিক এ মুহূর্তে উর্মিকে ঘিরে কত স্মৃতি, কতো কি? গভীর রাতে বাসায় ফিরে নিচে থেকে কোনদিন কল দিলেই উর্মি ফোন না ধরে সঙ্গে সঙ্গে তার রুমের বারান্দায় বেরিয়ে আসে। নিচে তাকিয়ে দেখে আমি কী হোন্ডা, নাকি সিএনজিতে এসেছি। নাকি সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে রিকসা? কিছু না বলেই রুমে ঢুকে সিগারেটের প্যাকেটে ঢুকিয়ে নয়তো ১০০ টাকা, না হয় ২০০ টাকা ভরে নিচের দিকে ফেলে আর মুখে শুধু বলে বাবা! আমি দেখি সিএনজিতে গেলে ২০০ আর মোটর সাইকেল কিংবা রিকসায় গেলে ১০০ টাকা দেয়াটাই তার বাধা ধরা রেট। আমি লিফটে উপরে উঠে এলেই দরজা খুলে তার হাসিমুখ দেখে কখনো কখনো নিজেই লজ্জা পেয়ে যাই। বলে উঠি: কী ব্যাপার, আমার টাকা সঙ্কট দেখে তুমি কী টিটকারী করছো? উর্মি হাসতেই থাকে...না বাবা না, তোমার টাকা সঙ্কটে আমি প্রাউড ফিল করছি। ভাবছি আর যাই হোক, উৎসহীন আয়ের হাজার হাজার টাকায় তোমার পকেট ভরা নেই-আলহামদুলিল্লাহ।
*আমার মেয়েটির জন্য আবারও সকলের দোয়া কামনা করছি।