নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মানিকগঞ্জের সিংগাইরে বিদেশ ফেরত সাগর আলী (২২) নামের এক তরুণের লাশ ধামরাই উপজেলার রোয়াইল ইউনিয়নের দক্ষিণ সুঙ্গরচর এলাকা থেকে উদ্ধার করেছে ধামরাই থানা পুলিশ। নিহত সাগর আলী সিংগাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের খাসেরচর (লাঙ্গুলিয়া) এলাকার তাছের আলীর ছেলে। তার মৃত্যু নিয়ে এলাকায় চলছে তোলপাড়। সাগরের আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে থানা পুলিশ।
সোমবার (২৮মার্চ) লাশটি উদ্ধারের পর ছুরতহাল রিপোর্ট করে রাজধানীর হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী হাসপাতালে ময়না তদন্ত শেষে মঙ্গলবার (২৯ মার্চ) সন্ধা ৭ টায় জানাযা শেষে দাফন করা হয়।
১৬ বছর আগে অনেকটা একই রকম মৃত্যু হয়েছিল সাগরের গর্ভধারিণী মা খোদেজা বেগমেরও (২১) । ১৬ বছর পর একই পরিণতির শিকার হলেন বিদেশ ফেরত ছেলেও।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সাগর আলী সাত-–আট মাস আগে লেবানন থেকে দেশে ফেরেন। তিনি বাবার বাসায় থেকে কৃষিকাজ করতেন। ২২ মার্চ দুপুরে গোসল শেষে সাগরের সৎ মা ও ফুফু মিলে চেইন চুরির নাটক সাজায়। তারা দু’জন মিলে পাড়া মহল্লায় প্রচার করে সাগর সৎ মায়ের গলার চেইন চুরি করেছে। এর পর চোর চিহ্নিত করতে মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার চান্দহর ইউনিয়নের ওয়াইজনগর গ্রামের ফকির মো. জালাল উদ্দিনকে বিকাল ৫টার দিকে নিয়ে আসে সাগরের বাবা। গ্রামবাসীর উপস্থিতিতে হাত ও বাটি চালান দিয়ে ফকির জালাল উদ্দিন সাগরকেই চোর বলে চিহ্নিত করেন। এরপর পিতাসহ পরিবারের লোকজন সাগরের হাত-পা বেঁধে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এতে সে গুরুতর আহত হলেও তাকে চিকিৎসার জন্য না নিয়ে ঘরের আটকে বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে রাখে। এর পর সোমবার (২৮মার্চ) সকাল ৭টার দিকে বাড়ি থেকে প্রায় ১৫০ মিটার দূরে ধামরাইয়ের চরসুঙ্গর এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর পশ্চিম পাশে ডুমুর গাছের সঙ্গে গামছা ঝুলিয়ে ফাঁস লাগানো অবস্থায় তাঁকে দেখতে পান চাচাতো ভাই আজিজুল (১৮)।
ঘটনাটি দুই থানার সীমান্তবর্তী এলাকায় হওয়ায় বিষয়টি তৎক্ষণাৎ সিংগাইর ও ধামরাই থানা পুলিশকে অবহিত করা হয়। ঘটনাস্থল ধামরাই থানার অর্ন্তগত হওয়ায় ধামরাই থানা পুলিশ ঝুলন্ত মরদেহটি উদ্ধার করে। এরপর মরদেহের ছুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি শেষে ময়না তদন্তের জন্য রাজধানীর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন সিংগাইর ও ধামরাই থানা পুলিশ।
এ ঘটনায় সাগরের ছোট বোন তাসলিমা খাতুন সোমবার রাতেই তিনজনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরও– ২-৩ জনকে আসামি করে আত্মহত্যা প্ররোচনার অভিযোগ এনে মামলা করেন। এরপর পুলিশ অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে।
গ্রেপ্তার তিনজন হলেন নিহতের সৎমা ফাহিমা (৪০), ফুফু হাজেরা বেগম (৪৮) ও চাচা ইসমাইল হোসেন (৪৪)। অভিযুক্ত ব্যক্তিরা সবাই মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার ধল্লা ইউনিয়নের খাসেরচর (লাঙ্গুলিয়া) এলাকার বাসিন্দা। গ্রেপ্তার তিনজনকে মঙ্গলবার আদালতে পাঠানো হয়।
তাসলিমা খাতুন বলেন, ২০০৬ সালের ১৭ জুন তাঁর মা আত্মহত্যা করেন বলে তাঁর দাদির পরিবারের সদস্যরা দাবি করেন। ওই সময় তাঁর মাকে ঘর থেকে টাকা চুরির অপবাদ দেওয়া হয়েছিল। তাসলিমার দাবি, মূলত নেশাগ্রস্থ ছোট কাকা বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে পালিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু অপবাদ দেওয়া হয়েছিল মাকে। সে সময় মা মারা যাওয়ার পর দাদা আমাদের দুই ভাই-বোনের নামে চার বিঘা জমি দেন। আমরা মামার কাছেই বড় হই। ভাই সাত–-আট মাস হলো লিবিয়া থেকে ফিরে বাবার সঙ্গে থাকতে শুরু করেছিল। মায়ের মতো ভাইকেও ওরা মেরে ফেলেছে। আমি এর বিচার চাই।
স্থানীয়রা জানান, স্বামী তাইছের আলীকে (৪৯) বিয়েতে বাধা দেওয়ায় সাগরের মা খোদেজা বেগমকে হাত-পা বেঁধে ধলেশ্বরী নদীতে ফেলে দেন স্বামী। তাইছের খাদিজাকে মরদেহ গাছের সঙ্গে ঝুলিয়ে রেখে নিছক আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেন। সে সময় এই বিষয়টি নিয়ে শ্বশুর বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. জালালউদ্দিনের হাতে পায়ে ধরে ও দুই বছরের শিশুপুত্র সাগর ও তাসলিমার নামে ১০০ শতাংশ (এক একর) জমি লিখে দিয়ে হত্যা মামলা থেকে বেঁচে যান ঘাতক তাইছের আলী। এরপর থেকে সাগর তার নানি আফরোজা বেগমের কাছে লালিত-পালিত হন।
নানি আফরোজা বেগম জানান, নিজের পায়ে দাঁড়াতে তিনি মাত্র ১৬ বছর বয়সে লেবানন প্রবাসে চলে যান চাকরি করার জন্য। ৫-৬ বছর লেবাননে প্রবাস জীবন শেষে ৭-৮ মাস আগে দেশে ফিরে এসে পিতার কাছ থেকে নিজের নামে লেখা জমি বুঝিয়ে নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানায় সাগর। আর তখন থেকেই সৎ মা ফাহিমা আক্তার ও ফুফু হাজেরাসহ পরিবারের লোকজন গোপন ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। আমার মেয়ের মতই আমার নাতিরও একই পরিণতি হয়েছে। এর সঠিক বিচার দাবি করেন তিনি।
এ ব্যাপারে ধামরাই থানার অফিসার ইনচার্জ পুলিশ পরিদর্শক মো.আতিকুর রহমান আতিক বলেন, খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে অতীতের ঘটনা সম্পর্কে অবগত হই। মরদেহের ছুরতহাল প্রতিবেদন শেষে ময়না তদন্ত হয়েছে। এ বিষয়ে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। ময়না তদন্তের রিপোর্টের পর পরবর্তী আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানান তিনি।