নিজস্ব প্রতিবেদক, আশুলিয়া : নানান অনিয়ম, দুর্নীতি, ঘুষনীতি, একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার ও নিজস্ব সিন্ডিকেট গড়ে তোলার খবর পাওয়া গেছে ঢাকা আশুলিয়ার এসিল্যান্ডে কর্তব্যরত এক সার্ভেয়ার ও ভারপ্রাপ্ত কানুনগো’র বিরুদ্ধে। প্রায় নয় মাস আগে এই দু’জন অফিসার ঢাকা ডিসি অফিস থেকে বদলিপ্রাপ্ত হয়ে আশুলিয়া এসিল্যান্ডে একজন সার্ভেয়ার ও আরেকজন ভারপ্রাপ্ত কানুনগো হিসাবে কাজে যোগ দেন। বিভিন্ন মাধ্যমে জানা যায়Ñ যোগদানের পর থেকেই সার্ভেয়ার মো. আবু বক্কর সিদ্দিক চৌধুরী ও সার্ভেয়ার মোহাম্মদ শাখাওয়াত হোসেন সরকার (কানুনগো ভারপ্রাপ্ত) বর্তমান এসিল্যান্ড’র ভালো মানুষী ও সহজ সরলতার সুযোগ নিয়ে নিজস্ব সিন্ডিকেট, একক সেচ্চাচারীতা ও সর্বোচ্চহারে ঘুষ আদায়ের এক পৈচাশিক আবাসস্থল গড়ে তুলেছেন। টাকা ছাড়া এই দু’জনের কাছে থেকে সেবা না পাওয়া ভূমি জোতদারদের ভাষ্যমতেÑ আশুলিয়া এসিল্যান্ডের সার্ভেয়ার ও কানুনগো যেন মহাক্ষুধার্ত রাঁজহাস!
বিগত সাত আট বছরের মধ্যে আশুলিয়া এসিল্যান্ড অফিসে এরকম সিন্ডিকেটধারী, দুর্নীতিবাজ, ঘুষখেঁকো অফিসার আশুলিয়াবাসী আগে কখনো দেখেনি! তারা নগদ টাকা পেলে কাজ করে, টাকা না পেলে নানান অযুহাত এনে নির্ভেজাল কাজও ভূমি সহকারী কমিশনার বরাবর না মঞ্জুরের সুপারিশ করে পাঠায়। ভূমি অফিসের দুজন সিনিয়র ব্যক্তি’র (সার্ভেয়ার ও কানুনগো) মাধ্যমে যখন কোনো নামজারি নথি এসিল্যান্ড বরাবর না মঞ্জুরের সুপারিশ করা হয়, তখন ভূমি সহকারী কমিশনার মহাদয়ের আর কিছুই করার থাকে না। কমিশনার সাহেবও তখন তাদের তালে তাল মিলিয়ে সাক্ষর করেনÑ সার্ভেয়ার ও কানুনগো’র ভাষ্যমতে নামজারি ও জমাভাগের কেইসটি না মঞ্জুর করা হলো! এই যদি হয় ভূমি সেবা! মানুষ যাবে কোথায়? আশুলিয়া এসিল্যান্ড অফিসে সেবা নিতে আসা অসহায় ভূমি মালিকদের মুখে মুখে শোনা যায়Ñ ‘অত্র অফিসের ঘুষখোর দুটো প্রাণির নাম সার্ভেয়ার ও কানুনগো!’
নামজারি নথি বা কেইস বাতিল করে যেন ভবিষ্যতে কোনো জবাবদিহির মখোমুখি না হতে হয় তারও বহু কৌশল তাদের নিজস্ব ফরমেটে তৈরি করা আছে। একটা নির্ভেজাল কাজে তাদের চাহিদা মতো টাকা না পেলে নামজারি বাতিলের সুপারিশ এমনÑ‘মূল কাগজপত্র বা দলিল প্রদর্শন না করায় অত্র নামজারি না মঞ্জুর করা যেতে পারে’! অথচ, তাদের সিন্ডিকেট বাহিনির বেলায় এ ধরনের কোনো অযুহাত নেই এবং সারাদিনে দু চারটি মূল দলিল বা মূল কাগজ দেখেছে এরকম নজির খুবই কম। আবার হয়তো কারো কারও নামজারি নথিতে মনগড়াভাবে লিখে রাখেÑ নকশা, পেন্টা লাগবে বিধায় না মঞ্জুরের সুপারিশ! আবেদনকারী নিজে উপস্থিত না থাকায়; না মঞ্জুরের সুপারিশ! অথবা দলিল দাতার/গ্রহিতার বাবার/মায়ের নামের এক অক্ষর ভুল বা এ-কার নাই, আ-কার নাই বা ও-কার নাই, এইসব নিয়েও না মঞ্জুরের সুপারিশ! ওয়ারিশিয়ান সার্টিফিকেট ছয় থেকে এক বছরের পুরোনো হলেই তারা সরকারি নির্দেশনা দেখাবে যে- চলবে না, নিম্নতম তিন মাসের আপডেট লাগবে। সাধারণ পাবলিকের কাজে এরকম আপডেট কাগজ না থাকলেও নামজারি বাতিলের সুপারিশ করা হয়! অথচ, এমনও খারিজ ডেলিভারি দেওয়া হয়েছে; যার ওয়ারিশিয়ান সার্টিফিকেট একদম জাল, ফুটপাত থেকে বানানো, সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং তা কোনো স্থানীয় চেয়ারম্যান বা পৌর মেয়র কর্তৃক প্রদত্ত নয়! শুধু তাই নয়, ২০২২ সালের নামজারিতে ২০০৯ সালের হাতে লেখা সম্পূর্ণ এনালক পদ্ধতির ওয়ারিশিয়ান সার্টিফিকেট লাগিয়ে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে খারিজ করে দেওয়ার কূ-কীর্তি আছে সার্ভেয়ার বক্কর ও ভারপ্রাপ্ত কানুনগো শাখাওয়াতের! সেবাপ্রার্থী লোকজনের মুখ থেকে জানা যায়Ñ ‘তারা এখানে আসছে শুধু টাকা কামাতে, এখান থেকে যা পারে কামিয়ে নিয়ে অন্য কোথাও বদলি হয়ে যাবে’।
একই কাগজ বা দলিল পর্চা দিয়ে আবেদনকৃত বহু নামজারি কেইস বাতিল হয়েছে শুধুমাত্র নির্ধারিত ঘুষের টাকা না দেওয়ার কারণে। সেই একই কাগজপত্র ও দলিল পর্চা দিয়ে পূনরায় আবেদন করে যথাযথভাবে সার্ভেয়ার কানুনগো নির্ধারিত ফি পরিশোধে খারিজ ডেলিভারি নেওয়ার নজির আছে শত শত! তাদের সেই নির্ধারিত ফিস গ্রহণের জন্য আছে নিজস্ব জনবল ও গোপন হিসাবের খাতা। সে খাতা এবং নগদ টাকা জমা রাখেন সিন্ডিকেট বাহিনির খোকন নামের এক চতুর সদস্য। যিনি নন অফিসিয়ালম্যান হয়েও বীরদর্পে নিত্য অফিস করেন সার্ভেয়ার ও কানুনগো’র নির্দেশে! খোকন নামের এই ছেলেটিই; যাকে ধামরাই এসিল্যান্ড অফিসে মাষ্টাররুলে চাকরি করাবস্থায় দুর্নীতির দায়ে চাকরি থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো! সেই ছেলেটিই কিনা আবারও আশুলিয়া এসিল্যান্ড অফিসে! ভাবা যায়? নিজেদের লোক সেটিংস এর সুবিধার্থে পুরাতন মাষ্টাররুলে চাকুরীরত লোকদের বিভিন্নভাবে বিতাড়িত করে পাকাপোক্তভাবে গড়েছেন ঘুষ দুর্নীতির আখড়া!
উপরে বর্ণিত অপরাধগুলো খুবই সামান্যতম মনে হবে যদি শোনা যায় কাজের ধরন বুঝে ঘুষের টাকার অংক নির্ধাারণ করে দেওয়া হয়! ডিসিআর ফি সরকার নির্ধারিত ১১৫০ টাকা বর্তমানে অনলাইনে জমা নিলেও নাজির শাখায় এক্সট্রা ৫০০-৭০০ টাকা জমা দিয়ে তারপর আগত ও চলমান জোত খতিয়ান পোষ্টিং নিতে হয়। নামজারির সর্বশেষ ধাপে এসে উক্ত বর্ণিত নামজারির ফি বাদে এক্সট্রা টাকাটা না দিলে জোত খতিয়ান আর পোষ্টিং দেওয়া হয় না। ফলে অনলাইন থেকে ডিসিআর এর ১১৫০ টাকা জমাদানের যে সরকারি ম্যাসেজ, তা আর গ্রাহকের মোবাইলে আসে না! কয়েকদিন পরে গ্রাহক জানতে পারে, পেন্ডিং জটিলতার কারণে তার নামজারি জমাভাগের প্রস্তাবটি বাতিল করা হয়েছে! এই সমস্যাটি আশুলিয়া এসিল্যান্ডে বর্তমানে মারাত্মক ভয়াবহ ও মহামারীর রুপ ধারণ করেছে! এর সম্পূর্ণ দায়ভার ও দোষ চাপানো হচ্ছে সাধারণ জনতার কাঁধে। বলা হচ্ছে- সময়মত ডিসিআর ফি জমা না দেওয়ায় অটো বাতিল হয়েছে! অথচ, ডিসিআর ফি জমা দেওয়ার কোনো ম্যাসেজ-ই আসেনি। মূলত অফিসের সেকেন্ড ইন কমান্ড হিসাবে কানুনগো সাহেব যাকে যেখানে যেভাবে সেটিং করে দিয়েছে, সে সেভাবেই তাদের সিন্ডিকেটের কাজ নিয়ে ব্যস্ত, জনগণের কথা ভাবার মতো সময় তাদের নেই। সে জন্য নেজারত শাখায় ঢুকলেই দেখা যায়Ñ এখানে কেউ হয়তো কাজ করতে আসেনি, মনে হয় সবাই বিকাশ, রকেট ও নগদের ডিলারশীপ নিয়ে দিব্যি ব্যবসা করছেন!
সার্ভেয়ার ও কানুনগো’র সাথে কাজ করা একজনের সাক্ষাৎকারে জানা যায় (যা গোপন ক্যামেরায় ধারণকৃত), ভূমি সহকারী কর্মকর্তাসহ পুরো এসিল্যান্ড অফিসটাকে আঙ্গুলে তুলে নাচাচ্ছেন কানুনগো শাখাওয়াত সাহেব একাই! উনার সামনেই নাকি শাখাওয়াত সাহেব একদিন এসিল্যান্ডকে বলেছেনÑ আপনার কিছু বোঝার দরকার নাই, অফিস কিভাবে চালাতে হয়, আপনে শুধু দেখবেন। এসিল্যান্ড স্যার খুব ভালো ও সরলসোজা হওয়ার জন্যে সার্ভেয়ার-কানুনগো’রা তার মাথায় কাঁঠাল ভেঙ্গে খেতে পারছে।
তার ওপেন সিক্রেট কথায় জানালো সার্ভেয়ার ও কানুনগো’র টেবিলে বিভিন্ন কাজের রেট। বি আর এস খাস দাগ ১৫ হাজার টাকা, এস এ, আর এস ৮নং রেজিস্টার দাগ হলে ১৫ হাজার টাকা, এল এ দাগ ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা, খ তালিকা হলে ৩ থেকে ৫ হজার টাকা, নির্ভেজাল প্রতি পিছ কাজের রেট ১ হাজার টাকা!
তাদের ঔদ্ধোত্বপূর্ণ আচরণ ও অহমিকামূলক কথাবার্তায় বোঝা যায়; তারা আশুলিয়া এসিল্যান্ড অফিসে রাজ করতে এসেছে, লুট করতে এসেছে, শোষন করতে এসছে! তারা কোনো পাবলিক সেবা দিতে আসেনি! সাধারণ ভূমি জোতদারগণ সেবা পেতে এসে ক্ষীপ্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। রাগে ক্ষোভে কেউ কেউ সার্ভেয়ার ও কানুনগো অপসারনের জন্য মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে আশুলিয়াবাসীর পক্ষ থেকে বেশ কিছু আইনজীবীর মাধ্যমে এই সার্ভেয়ার বক্কর ও কানুনগো শাখাওয়াত নামক কসাইদের অপসারনের জন্য ঢাকা জেলা প্রশাসক বরাবর সরাসরি অভিযোগ করেছেন।